Monday, January 5, 2015

ফ্রিল্যান্সিং এবং কাঁড়ি কাঁড়ি টাকার মুলা

Julianna | 9:14 PM |


ওয়েল প্রথমেই যদি লেখার ধরন বুঝতে না পারেন, তাহলে বলে রাখি, এটা একটি "পট্টি উন্মোচন" ধরনের লেখা। ফ্রিল্যান্সিং করে লাখ লাখ টাকা কামিয়ে বড় লোক হয়ে যাওয়ার যে "পট্টি" কতিপয় লোক ধারন করেন কিংবা প্রচার করেন, সেই পট্টি চোখ থেকে খুলে ফেলার একটি নগন্য চেষ্টা।
ফ্রিল্যান্সিং আসলে কি? ফ্রিল্যান্সিং এর বেসিক আইডিয়া হলো একজন ব্যাক্তি যখন একটি নির্দিষ্ট ব্যাক্তি বা কোম্পানীর আওতায় বা অধীনে কাজ না করে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন লোক বা কোম্পানীকে সার্ভিস দিয়ে থাকে। এই মূহূর্তে ফ্রিল্যান্সিং শব্দ শুনলেই মানুষ কম্পিউটারে সামনে বসে ইনকাম করার কথা বোঝে। ওয়েল, ফ্রিল্যান্সিং আরও অনেক ক্ষেত্রেও হয়। আমাদের দেশেই প্রচুর ফ্রিল্যান্স ফটোগ্রাফার আছেন, যারা নির্দিষ্ট টাকার বিনিময়ে সংবাদপত্র বা ম্যাগাজিনে নিজেদের ছবি বিক্রি করে। ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক আছে, যারা যখন যেটাকে মনে হয় বা যোগ্য মনে করেন, সেই পত্রিকায় বিভিন্ন সংবাদ পাঠান। কিন্তু কারও অধিনস্ত নন।
এখন যেদিকেই তাকায়, সবাই ওডেস্ক, ইল্যান্স আর ফাইভার নিয়ে মাতামাতি করে। এর আগেও প্রিয়তে এই বিষয়ে একটা লেখা দিয়েছিলাম যে অল্প বিদ্যা কিভাবে ভয়ংকরী হতে পারে। আসলে আমাদের সমস্যাটা কোথায়?
প্রথমদিকে যখন প্রচুর পরিমান ছেলে এই লাইনে আসছিলো তখন ভাবছিলাম, এরা সবাই নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়। এরা স্বাধীন হতে চায়। বাবা মার ওপর থেকে চাপ কমাতে চায়। সত্যি কথা বলতে, আমার ক্ষেত্রেও বিষয়টা তাই ছিলো। নিজের ইনকামের টাকায় চলবো, এরচেয়ে মজার বিষয় আর কি হতে পারে? কিন্তু আমাদের দেশে যেভাবে প্রতিটা ভালো জিনিসই একদিন ডুবে যায়, এই ফিল্ডেরও একই অবস্থা হয়েছে।

আপনার ঘাটতি আসলে কোথায়?

ফ্রিল্যান্সিং একটা চ্যালেঞ্জিং সেক্টর। এখানে প্রথম চ্যালেঞ্জ হলো, আপনি মাসের শেষে যে টাকা পাবেন, তার কোন গ্যারান্টি নেই। যেটুকু কাজ করবেন, সেটারই টাকা পাবেন। কাজ না করলে পাবেন না। ওডেস্ক বাংলাদেশ নামে একটা ফেসবুক গ্রুপ আছে, সেখানে প্রতিদিন দেখি প্রচুর পোষ্ট আসছে, আমি এতোদিন ধরে বিড করি, কাজ পাইনা কেন?
কেন কাজ পাবেন আপনি? একজন ক্লায়েন্ট আপনাকে কেন কাজ দেবে? কি প্রমান আছে যে আপনি আসলেই কাজটা করতে পারবেন? কি গ্যারান্টি আছে যে আপনি কাজ নেওয়ার পরে কাজ সম্পন্ন করবেন? কেন একজন ক্লায়েন্ট আপনার ওপরে ভরসা করবে? আপনার কি নিজের ওপর কনফিডেন্স আছে যে আপনি কাজটা শেষ পর্যন্ত সুচারু ভাবে সম্পন্ন করতে পারবেন? ক্লায়েন্ট আপনার কাছে কি চাচ্ছে, সেটা কি আপনি বুঝতে পারছেন? আপনি কি বলছেন, সেটা ক্লায়েন্টকে বোঝাতে পারছেন?
এই প্রশ্ন গুলোই হলো আপনার ঘাটতি। যতোক্ষন এই প্রত্যেকটা প্রশ্নের উত্তর পজেটিভ না হচ্ছে, আপনার মধ্যে ঘাটতি রয়েছে। কোন ট্রেনিং, কোন শিক্ষক, কোন যায়গায় ইন্টার্নশীপ আপনাকে এই ঘাটতি থেকে মুক্তি দিতে পারবে না। এই ঘাটতি থেকে মুক্তি পেতে হলে আপনার নিজের মস্তিস্ককে আগে প্রস্তুত করতে হবে।
এই পর্যন্ত পড়ার পরে নিশ্চিত ভাবে বলা যায় অনেকে ধরেই নিয়েছেন আমি চাই না কেউ ফ্রীল্যান্সার হোক বা আমার ভাত মারা যাবে বলে প্রতিযোগী চাই না ইত্যাদি ! ব্যাপারটা তা নয়। সমস্যাটা আসলে আরও বড় যায়গায়। আমি চাই না আমার দেশের নাম খারাপ হোক।
আমি আজ পর্যন্ত যতগুলোর ক্লায়েন্টের সাথে কাজ করেছি, তার মধ্যে শতকরা ৩০ ভাগই বলেছে বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সারদের সাথে তাদের অতীতের অভিজ্ঞতা ভালো নয়। কমিউনিকেশনে সমস্যা, কাজের মধ্যে প্রফেশনালিজম নেই, টাইমিং নিয়ে সমস্যা, কাজ সম্পূর্ন না হওয়া, কাজের মাঝেই গায়েব হয়ে যাওয়া, নিম্নমানের কাজ ডেলিভারী দেওয়া ইত্যাদি। ফলে দেখা যায়, আরও যারা ভালো কাজ করছেন, তাদের এসব ক্লায়েন্ট নিয়ে সমস্যার মধ্যে পড়তে হয়। বাংলাদেশী বলে কাজ দিতে চায়না।

মুক্তির উপায়?

বিস্তারিততে যাওয়ার আগে আরেকটা বিষয় নিয়ে আলোচনা করি। টিউশনি, বাংলাদেশের তরুন সমাজে এখনও বড় ধরনের ইনকামের একটা রাস্তা। ব্যাচে বা একা ষ্টুডেন্ট পরিয়ে ইনকামের মাধ্যমে অনেকেই জীবন যাপন করে আজকে ভালো অবস্থানে আছেন। একটা সময় টিউশনি করাটা ( এখনও ) মাষ্ট বি কাজ ছিলো। টিউশনি না করলে সেই ছেলে লাইফে টাকার মূল্য জানবে না, টিউশনি করলে সময়ের ভ্যাল্যু বোঝা যায় ইত্যাদি কথা প্রচলিত ছিলো। কে কতো ভালো ছেলে সেটার মাপকাঠিও ছিলো টিউশনি। কিন্তু দিনের শেষে, সবাই সারাজীবন টিউশনি করে কাটায় না। কেউ কেউ এই লাইনে ন্যাচারাল, তারা একটা কোচিং সেন্টার খুলে সেখানে আরও কয়েকজন টিচারকে নিয়ে কাজ করে। বাকিরা প্রফেশনাল লাইফে ফিরে যায়।
এখানেও ব্যাপারটা অনেকটা সেরকম। ফ্রিল্যান্সিং কোন দিক দিয়েই সহজ কাজ নয়। দিন রাত পরিশ্রম করা, ক্লায়েন্টের সাথে কমিউনিকেশন ম্যানেজ করা, আমাদের ব্যাংকিং সেক্টর এর কৃতিত্বে টাকা তোলা নিয়ে আরেকদফা ঝামেলা করা, এবং দিনের শেষে কাজ খোঁজা। আপনি যদি ভেবে থাকেন, ফ্রীল্যান্সিং মানেই কম্পিউটার এর সামনে বসে থাকা আর আপনার ব্যাংক ব্যালেন্স ফুলে ফেঁপে ঢোল হয়ে যাবে, বসন্তের এখনো অনেক বাকি বৎস।

কি করা উচিৎ?

ওয়েল, ফ্রিল্যান্সিং এর শুরুতেই আপনাকে আগে নিজের যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। স্কিল। আপনি যে সেক্টরে কাজ করতে চান, সেখানে আপনাকে দক্ষতা অর্জন করতে হবে। তাহলে কি করা যায়? ট্রেনিং সেন্টারে যাবেন? অন্য কোন ফ্রিল্যান্সার এর পেছনে লাইন দিয়ে বেড়াবেন? সারাদিন ভিডিও টিউটোরিয়াল ডাউনলোড করে দেখতে থাকবে?
আগে আপনাকে কয়েকটি বিষয়ে নিশ্চিত হতে হবে। আসুন সেগুলো নিয়ে আলোচনা করা যাক।

আপনার হাতে কি সময় আছে?

এটা একটা মারাত্নক প্রশ্ন। ফ্রিল্যান্সিং এর যে কোন সেক্টরে কাজ শুরু করার আগে যে পরিমান সময় দিতে হবে, সেটার কোন হিসাব নেই। তার আপনার যদি প্রতিদিন একটা ভালো পরিমান সময় এর পেছনে ব্যায় করা সুযোগ না থাকে, তাহলে এই সেক্টরে আপনাকে হতাশ হতে হবে।

আপনার হাতে কি পর্যাপ্ত পরিমান টাকা আছে?

এখানে আসলে টাকা বলতে শুধু টাকা বোঝানো হচ্ছে না। আপনি যদি এখন এস এস সি পরীক্ষার্থী হন বা পাশ করে থাকেন, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের সচরাচর পরিস্থিতিতে আপনার পরিবার আপনাকে আরও দুই বছর সাপোর্ট দেবে। কারও কপাল ভালো হলে অনার্স শেষ করা পর্যন্ত। আগে নিশ্চিত হন, আপনার কাছে সে রকম সাপোর্ট আছে। কারন আপনার কপাল খুব ভালো হলেও, অন্তত এক বছর আপনাকে কাজ শিখতে এবং বুঝতে হবে। মানে এই সময়টা আপনার কোন ইনকাম নেই। তার সেই সময়টুকু চলার মতো সাপোর্ট আপনার থাকতে হবে।

আপনি কি কম্পিউটার এর প্রতি প্যাশনেট?

প্যাশন বা আসক্তি খুবই জরুরী এই ক্ষেত্রে। ঠেকায় পরে কিংবা দায়সাড়া আবেগ দিয়ে প্রফেশনাল লাইফ কিংবা পার্সোনাল লাইফ কোনটাই ভালো যায়না। কম্পিউটার এবং এর অভ্যন্তরীন ব্যাপারগুলোর প্রতি আপনার ভালোবাসা থাকতে হবে। সেগুলো জানার আগ্রহ থাকতে হবে। যদি আগ্রহ বাদ শুধু টাকা ইনকামের ধান্দায় এই লাইনে আসেন, আপনার এখনই কেটে পড়াই উত্তম।

আপনি কি নিজে নিজে শিখতে সক্ষম?

এটা সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। স্কুলে আপনার শিক্ষকরা আপনাকে পড়া শেখায় না, আপনাকে কিভাবে পড়তে হবে, সেটা শেখায়। বাসায় গিয়ে আসল পড়ার দ্বায়িত্বটা আপনার। এক্ষেত্রেও তাই। কোন ট্রেনিং সেন্টার বা শিক্ষক আপনাকে ওয়েব ডিজাইন বা সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন গুলিয়ে খাইয়ে দেবে না। তারা বড়জোর রাস্তা দেখিয়ে দেবে। সেই রাস্তায় চলতে হবে আপনাকে। তাই নিজে নিজে শিখে কাজ করাটা সবচেয়ে বড় গুণ। আপনাকে কেউ HTML এর নাম বলে দিলে যেন আপনি তার ট্যাগগুলো জেনে নিতে পারেন নিজে থেকে, সেই মানসিকতা থাকতে হবে।

আপনার কি নতুন টেকনোলজির প্রতি আগ্রহ রয়েছে?

এটাও একটা বার্নিং প্রশ্ন। আমি যখন CSS3 নিয়ে সিরিয়াসলী কাজ করা শূরু করেছি, তার দুই সপ্তাহ পরেই CSS4 এর স্পেসিফিকেশোন রিলিজ হয়েছে। মানে আমি CSS3 নিয়ে কাজ করতে অনেক দেরী করে ফেলেছিলাম। প্রতিদিন নতুন নতুন টেকনোলজি আসছে। নতুন সার্ভিস আসছে। সেগুলোর নিয়ে জানার এবং কাজ করার আগ্রহ থাকতে হবে। আজকে দশটা নতুন টেকনোলজি আসলে তার একটা দেখা যাবে আপনার অনেক কাজ কমিয়ে দিয়েছে।

আপনার কি কম পরিশ্রমে টাকা দরকার?

যদি উত্তর হ্যাঁ হয়, তাহলে আরেকবার ভেবে দেখতে পারেন। পৃথিবীতে পরিশ্রম এর ইফিশিয়েন্সি সর্বদাই ১০০ ভাগ। আপনি যা পরিশ্রম করবেন, আপনি তারই ফল পাবেন। বলতে পারেন, একজন অফিসের পিয়ন একজন অফিসারের চেয়ে বেশি পরিশ্রম করেন, তাহলে অফিসারের বেতন বেশী কেন? কারন সেই অফিসারকে সেই অবস্থানে পৌছানোর জণ্য যথেষ্ট পরিশ্রম আগে করতে হয়েছে। সে করতে পেরেছে বলেই আজকে তার বেতন বেশী। আপনি যা ইনপুট দেবেন, বিভিন্ন অবস্থার ভিত্তিতে সেই অনুপাতেই আপনি টাকা ইনকাম করতে পারবেন।
এখন আপনি কি করবেন, সিদ্ধান্ত আপনার। তবে কেউ যদি প্রমিস করে ফ্রীল্যান্সিং শুরু করলেই মাসে মাসে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা আসবে, তা সম্ভবত হীরক রাজার দেশও সম্ভব না। সে জন্য দরকার প্রচুর পরিমান পরিশ্রম এবং ডেডিকেশন। এবং আরও অনেক কিছু। উপরের প্রশ্ন গুলো আপনার জণ্য এক ধরনের পরীক্ষা। দেখুন পাশ করতে পারেন কিনা।
এবং সবশেষে, আমরা যা করি, এটাকে প্র্যাক্টিক্যালী আউটসোর্সিং বলে। ফ্রীল্যান্সিং শব্দটা অনেক বড় স্কেলের একটা সেক্টর এর নাম। আমাদের দেশে সবাই এটাকে কম্পিউটার এর কাজ বুঝলেও, আপনার ক্লায়েন্টরা এই শব্দের যত্রতত্র ব্যবহারে কনফিউজ হয়ে যেতে পারে। এর চেয়ে বরং আপনার নিজের লাইনের নাম বলুন, ওয়েব ডেভেলপার, ওয়েব ডিজাইনার, সার্চ ইঞ্জিন আপটিমাইজার, কন্টেন্ট রাইটার, ফ্রন্ট এন্ড ডেভেলপার ইত্যাদি। এতে সবার জন্যও ব্যাপারটি বুঝতে সুবিধে হবে।
আর মুলা খাবেন না। আমি অর্গানিক মুলার কথা বলছি না। ফ্রীল্যান্সিং করে মাসে মাসে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা কামানোর মুলা। এই মুলা বেশীরভাগ সময় আপনাকে ব্রোকেন একটা জীবনের দিকে নিয়ে যাবে, যেখানে আপনি টাকার লোভে পড়াশোনাকেও গোল্লায় পাঠিয়েছেন, ফ্যামেলীর সাথেও সম্পর্ক খারাপ করেছেন, বন্ধুবান্ধবকে সময় না দিয়ে তাদেরকেও হারিয়েছেন এবং দিনের শেষে ব্যাংক ব্যালেন্সে লাখ লাখ টাকাও আসেনি।
জীবনের প্রতিটা সিদ্ধান্ত বুঝে শুনে নিতে হবে। আগে ভাবুন, বুঝুন। আপনি আসলে কি চান। পরিশ্রম এর কোন বিকল্প নেই। হয়তো ৫ বছর পর আপনি এক লাইন কোড লিখে হাজার ডলার ইনকাম করবেন, কিন্তু সেই ৫ বছর সাধনার কোন বিকল্প কিন্তু নেই। আর এই বিকল্পহীন রাস্তায় হাঁটতে হলে, অনেক বাধা বিপত্তি আসবে। সেগুলো জয় করেই এগোতে হবে।

No comments:

Post a Comment

Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...
Twitter Delicious Facebook Digg Stumbleupon Favorites More

Search

Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...
Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...
Powered by Blogger.