(প্রিয় টেক) প্রতিনিয়তই আমরা নানা প্রকারের ধ্বংসের খবর দেখে অভ্যস্ত। গার্মেন্টস শিল্প ধ্বংস, শেয়ার বাজারে ধ্বস এমন খবর প্রতিনিয়তই আমরা দেখে আসছি। সেখানে ভিডিও গেমিং শিল্পেও ধ্বস এই খবরটির সত্যতা নিয়ে সন্দেহ হতেই পারে। চলুন দেখা যাক এই ধারনাটির জন্মের পিছনের পাঁচটি কারণ-
নেতৃত্বে গড়মিল
গেমিং এর মূলধারার সাথে যুক্ত নয় - এমন মানুষরা গেম ডেভেলাপারদের নেতৃত্ব দিচ্ছে। নেতা সবচাইতে ভালো বোঝেন, এই বিস্বাসেই দলের বাকিরা কাজ করে থাকেন। কিন্ত সবাই সবকিছু পারবেন - সেটিও সত্যি নয়। যিনি গেম বানানোর ব্যাপারে পারদর্শী তিনি ব্যবসায়িক ব্যাপারগুলো বুঝবেননা সেটাই স্বাভাবিক। ঠিক সেরকম একজন ব্যবসায়ী গেম ডিজাইন বা তৈরির ব্যাপারে খুটিনাটি বুঝবেন সেটা আসা করাটা ভুল হবে। অথচ গেম বানানোর কোম্পানিগুলো ঠিক এই ভুলটিই করছে, তারা ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারীদের ডেভেলাপমেন্ট টিমের লিডার হিসেবে বসাচ্ছে। এর ফলাফল হিসেবে তাদের ক্রিয়েটিভ ডিজাইনের নির্দেশনা নির্ভর করছে, অর্থাৎ গেমের ডিজাইন করছে তারাই, যারা কখনো গেম বানাননি এবং মূল লক্ষ্য হিসেবে ধরেছেন সেটির ব্যবসায়িক দিকগুলোকেই। একই ব্যপার হলিউডের সিনেমার ক্ষেত্রেও ঘটছে।
ব্যবসায়ীক সাফল্যের সাথে ক্রিয়েটিভির সম্পর্ক অনেকটাই উল্টো। অ্যাভেঞ্জারস মুভিটি চরম মাত্রায় ব্যবসায়ীকভাবে সফল হলেও সেটি ক্রিয়েটিভিটির দিক থেকে তেমন নতুন কিছুই দেখাতে পারেনি। সেভাবে আমরা কল অফ ডিউটি, ব্যাটলফিল্ডকে বলতে পারি ব্যবসায়ীকভাবে সফল কিন্তু সেটি কোনও ভাবেই লাস্ট অফ আস, আনচার্টেড এমনকি বায়োশকের মত ক্রিয়েটিভ নয়। এর চাইতে ভয়াবহ ব্যাপারটি হল ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারীদের টিম লিডার করার ফলে তারা বার বার একই ফরমুলা ব্যবহার করবেন। তাদের নতুনত্বের প্রয়োজন নেই, কম বাজেটে বেশী লাভ হলেই তারা সন্তুষ্ট।
এভাবে চলতে থাকলে নতুন কোনও কনসেপ্ট নিয়ে কেউ কাজ করবেনা, ফলে আমরা দিনের পর দিন একই কাহিনীর সিকুয়েল দেখতে পাবো, এখনকার চাইতেও বেশী। মাত্রই তুমুল জনপ্রিয় গেম “ডুম” এর ২০তম জন্মদিন গেলো, অথচ দেখুন সেটির সিকুয়েল মাত্র তিনটি। সেখানে এই মুহূর্তের ব্যবসায়ীকভাবে সফল গেম কল অফ ডিউটির সিকুয়েল ১০টি চলে এসেছে, সেটির থামার কোনও লক্ষন নেই। নিড ফর স্পিড এর কথা বাদই দেয়া হলও। এই দুটি গেমের ব্যপারে সবার একটিই মতামত, নতুন মোড়কে পুরাতন পন্য।
শুধু তাই নয়, প্রতিটি গেমের থেকে সর্বোচ্চ পরিমান মুনাফা করার লক্ষ্যে কোম্পানিগুলো আজকাল মূল গেমের বেশ কিছু অংশ আলাদ করে ডিএলসি করে বিক্রি করে থাকে। শেষ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে আজ ক্রেতারা আগের তুলনায় প্রায় দ্বিগুন অর্থ এক একটি গেমের পেছনে ব্যয় করছেন। এভাবে একই জিনিসের পেছনে গেমাররা আর খুব বেশীদিন ব্যয় করবেন না সেটা বোঝাই যায়।
ডেভেলপমেন্ট খরচ অত্যাধিক ফলে নতুনত্ব হয়ে পড়েছে দূরহ
আজকালকার একটি গেম তৈরির খরচ চিন্তা করাও কঠিন কাজ। ১৫-৩০ মিলিয়ন ডলার খরচ খুব সাধারন একটি ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে। এটি শুনে সবার মনে হতে পারে এ কারনে আরও ভালো গেম তৈরি সম্ভব, আসলে ব্যাপারটি তাই। সমস্যা হয়ে দাড়িয়েছে যেমন অতি সন্ন্যাসিতে গাঁজন নষ্ট, তেমন গেম তৈরিতে বেশী সংখ্যক ডেভেলাপার আর্টিস্ট ও অনান্য মানুষ থাকার ফলে গেমটির ক্রিয়েটিভ দিক নষ্ট হচ্ছে। বার বার দিকভ্রান্ত হয়ে যাচ্ছে। অতিরিক্ত বাজেটের ফলেই এই সমস্যার উৎপত্তি।
এই ব্যাপারটিও সামলে নেয়া সম্ভব ছিলো, শুধু দরকার সময়ের। যা আজকার সাংঘাতিক প্রতিযোগীতার বাজারে একেবারেই নেই। পুরনো গেম আর ইন্ডি ডেভেলাপারদের সাথে টিকে থাকার জন্যে দ্রুত গেমগুলোকে বাজারে আনতে বাধ্য হচ্ছে গেম নির্মাতারা, ফলে এই বিশাল টিমগুলো নিজেদের মাঝে বোঝাপড়া তৈরির সময়ও পাচ্ছেনা। ফলে প্রতিটি গেইমেই রয়ে যাচ্ছে প্রচুর বাগ এবংঅনান্য সমস্যা।
এর চাইতেও বড় সমস্যা হচ্ছে এই বিশাল বাজেটের গেমগুলোর ব্যয় কাটিয়ে লাভজনক করে তোলা। যেখানে কোন গেমটি বাজারমাত করবে সেটি জানার কোনও উপায় নেই - সেখানে কম্পানিগুলো নতুন কিছু না করে পুরাতন জনপ্রিয় গেমেরই সিকুয়েল আনবে - সেটাই স্বাভাবিক।
নির্মাতারা ক্রিটিকদের কাছ থেকে ভালো রিভিউ নিয়ে আসছে
একটি গেম কিনার আগে সবাই সেটার রিভিউ পড়েন। ভালো রিভিউ নাহলে গেমটি ফ্লপ করবে এমনটাই স্বাভাবিক। সেখানে নির্মাতারা অবশ্যই চাইবেন ভালো রিভিউ হোক তাদের গেমটির। সমস্যা হচ্ছে, তারা ক্রিটিকদের একপেশে রিভিউ করতে উৎসাহিত করছে। তার প্রমাণ ইতোমধ্যে বেশ কিছু গেমের রিভিউতে পাওয়া গেছে।
এর ২টি মূল কারণ বলা যেতে পারে। প্রথমটি হচ্ছে রিভিউকারীদের সাথে নির্মাতাদের নিবিড় সম্পর্ক। রিভিউ যারা করে থাকেন তারা দেখা যাচ্ছে নির্মাতাদের সাথে কাজ করছেন, তাদের সম্পর্ক দেখা যাচ্ছে খুবই ব্যাক্তিগত পর্যায়ের। এমন অবস্থায় তাদের রিভিউ একপেশে হবে সেটাই স্বাভাবিক।
দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে রিভিউ স্কোর করার সিস্টেম। গ্রাফিক্স, সিনেম্যাটিক্স, গেম লেংথ এবং অনান্য বিষয়ের ওপর সবচাইতে বেশি জোর দেয়া হচ্ছে যেখানে কাহিনী বা গেমপ্লের ওপর জোর দেয়া হচ্ছে অনেক কম। ফলে খুব সহজেই শুধু টেকনিকাল জিনিষের জোরেই একটি গেম ভালো স্কোর পাচ্ছে।
এভাবে চলতে থাকলে মানুষ খুব দ্রুতই ক্রিটিকাল রিভিউর ওপর বিশ্বাস হারাবে, ফলে নতুন গেমের প্রতি আস্থা থাকবেনা তাদের। গেম বিক্রির ওপর চরম প্রভাব পরবে এই স্ট্র্যাটেজির।
নতুন প্রযুক্তির আগমন এবং তার অজানা প্রভাব
প্রায়ই দেখা যাচ্ছে, গেমের ট্রেইলারের সাথে বা প্রথম প্রিভিউর সাথে মূল গেমের কোনও মিল নেই। অনেকেই অনুযোগ করছেন, কোম্পানিগুলো ভুয়া বিজ্ঞাপন দিয়ে গেম বিক্রি করছে, কথাটি অযৌক্তিক নয়। একপেশে রিভিউর মত এটির কারণেও ক্রেতারা গেম কোম্পানির ওপর আস্থা হারিয়ে কেনা কমিয়ে দিতে পারেন।
কেন এই ব্যাপারটি ঘটে তা এর আগের বিষয়গুলো দেখলেই বোঝা সম্ভব। বিশাল বাজেট ও টিম হবার ফলে কারও কাছেই আসলে পুরো গেমটির সব বিষয় ধারণা থাকছেনা। এর ওপর রয়েছে প্রতিনিয়ত বাজারের গতি বদল ও টেকনোলজির আপডেট। যেখানে একটি গেম বানাতে বেশ কিছু বছর চলে যাচ্ছে, সেখানে শুরুর ধারনাগুলো পরে অনেক বদল হবে সেটাই স্বাভাবিক - সাথে প্রকাশ হবার পর বিক্রির চাপ তো আছেই। গেমের বাজারের সাথে সাথে নতুন সব ফিচার যোগ করার চাপ সবসময় নির্মাতাদর ওপর থাকছে। সাথে রয়েছে নতুন সব টেকনোলজি যোগ করার চাপও। ফলে গেমটি তৈরি শেষ না হওয়া পর্যন্ত কেউই বলতে পারছেনা আসলে গেমটি কেমন হবে - এর ফলে শুরুতে ট্রেইলার মানুষের মনে গেমটির যে ছবিটি তৈরি করে তার সাথে পরে সেটির তেমন মিল থাকেনা। অথচ সাধারণ ক্রেতারা সেটিকে ভুয়া বিজ্ঞাপন ভেবে কেনার ইচ্ছাও হারিয়ে ফেলছেন। সত্যিকার অর্থে গেমিং জগতে আসলে কি হচ্ছে বা হবে তা বলা মুশকিল। অনেকটা অন্ধের মতন ছুটছে এখানে সকলে।
ডেভেলাপারদের ওপর মাত্রাতিরিক্ত চাপ
প্রতিটি কাজেই সংস্লিষ্ট সবার ওপর বেশ অনেক চাপ পরে। কিন্ত গেম নির্মাতাদের ওপর সেটি আর সবার চেয়ে আরও বেশি। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রতি সপ্তাহে তাদের ৬০-৮০ ঘন্টা কাজ করাতে হয়। অথচ এমন নয় যে তারা অনান্য কাজের চেয়ে বেশি টাকা পেয়ে থাকেন এ কাজটির জন্যে।
যেহেতু ডেভেলাপারদের অতিরিক্ত বেতনও দেয়া হয়না অথচ বেশি কাজ করতে হয় তাদের, অনেক গুনী ডেভেলাপাররা এই শিল্প ছেড়ে আরও সহজ সফটওয়্যার তৈরির কাজে হাত দিচ্ছেন। ফলে একেবারে নতুনেরাই রয়ে যাচ্ছেন এই শিল্পে, তাদের কাজ দেখিয়ে দেয়ার কেউও থাকছেন না।
সর্বশেষে আমরা দেখছি গেমিং শিল্প দিন দিন ট্যালেন্ট সম্পন্ন ডেভেলাপারদের হারাচ্ছে। শুধু তাই নয়, তাদের শুন্যস্থান পুরন করছে ব্যবসায়ীরা - ফলে দ্রুত নতুনত্ব হারাচ্ছে এই শিল্প। এভাবে চলতে থাকলে এই শিল্পটি ধ্বংসের দিকে চলে যাবে বলেই ভাবছেন বিশেষজ্ঞরা। এই ৫টি ট্রেন্ডের খুব দ্রুত পরিবর্তন প্রয়োজন।
No comments:
Post a Comment